রাহাদ সুমন, বিশেষ প্রতিনিধি : ও হাছিবুল ইসলাম, বানারীপাড়া প্রতিনিধি॥ “আমরা গরিব মানুষ। মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই ছিল, সেটুকুও চলে গেছে। গত ৬ মাস ধরে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছি। মানবেতর এ জীবনের শেষ কোথায়?” কান্না ভেজা কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন খেজুরবাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে উচ্ছেদ হওয়া এক বৃদ্ধ নারী। এমনই অসহায় ২৭টি পরিবার আবারও একটু নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় সরকারি দফতরের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার খেজুরবাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে উচ্ছেদ করা হয় এসব ভূমিহীন ও গৃহহীন হতদরিদ্র পরিবারগুলোকে। বৈধ দলিল ছাড়াই সরকারি ঘরগুলো দখল করে বসবাস করার অভিযোগে দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর ধরে বসবাসরত ৩১ টি পরিবারকে ঘরছাড়া করা হয়।
অথচ যাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে, তারা প্রকল্পের শুরু থেকেই সেখানে বসবাস করে আসছিলেন। কারও কারও শিশু জন্মেছে সেখানেই,কেউবা সন্তানদের বিয়েও দিয়েছেন আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে। অনেকের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর পরে দাফনও করা হয়েছে আশ্রয়ন প্রকল্পের কবরস্থানে। উচ্ছেদের পর থেকে তাদের মাথার উপর ছাদ নেই।
পলিথিন ও খড় টানিয়ে খোলা জায় গায়, কেউ কেউ আশ্রয়নের ঘরের বারান্দায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এমন অবস্থায় উচ্ছেদের শিকার হওয়া ৩১টি পরিবারের মধ্যে ২৭টি পরিবার মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) ফের জমিসহ ঘর পাওয়ার আশায় আবেদন জানিয়েছেন নবাগত বানারীপাড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আহসান হাফিজের কাছে। এসিল্যান্ড আহসান হাফিজ আবেদনগুলো গ্রহণ করে সরেজমিন যাচাইয়ের আশ্বাস দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, মানুষ যেন মানবেতর অবস্থায় না থাকে, সে বিষয়টি আমরা অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে দেখবো। নিয়মতান্ত্রিকভাবে যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।
আবেদন কারী এই ২৭ জনের মধ্যে রয়েছেন, সুমন বেপারী, রাজ্জাক বালী, মামুন হাওলাদার, তাসলিমা বেগম, সালাম বেপারী, সিদ্দিক মোল্লা, ইউসুফ আলী, সফিক বেপারী, হাফিজুল সরদার, আমজাদ হাওলাদার, আল আমিন ফকির, রাসেল হাওলাদার, আনিস মোল্লা, রিয়াজুল ইসলাম, ইয়ামিন ফকির, কাওসার বেপারী, আকাশ বেপারী, ফিরোজ হাওলাদার, ঝুমুর, বাদশা আকন, ইউসুফ আলী ফকির, রিপন, ফাইয়াজুল, ফারুক, জোছনা বেগম, শিল্পী বেগম ও আশিক মোল্লা। এরা সবাই হতদরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের ২২ মার্চ, তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় বরিশালের বানারীপাড়াকে ‘ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়। সেই ঘোষণার দেড় বছরের মাথায় ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের খেজুরবাড়ি আবাসনে উচ্ছেদ অভিযানে নামে বানারীপাড়া উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মো. বায়েজিদুর রহমান এ অভিযানের নেতৃত্ব দেন ।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বায়েজিদুর রহমান জানান, আবাসনের ওই ৩১টি পরিবার দীর্ঘদিন ধরে বৈধ দলিল ছাড়াই সরকারি ঘরগুলো দখল করে বসবাস করেছে। তারা যে মালিকানা দাবি করে কাগজপত্র দেখাচ্ছে, তা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এর আগেও, তাদের একাধিকবার ঘর ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা তা মানেনি। ফলে উপজেলা প্রশাসন বাধ্য হয়ে এসব ঘরে তালা লাগানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং তা বাস্তবায়ন করে। উচ্ছেদের শিকার ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা বা লিখিত নোটিশ ছাড়াই খেজুরবাড়ি আবাসনের ৩১টি পরিবারকে হঠাৎ করে ঘর থেকে বের করে দিয়ে তালা লাগিয়ে দেয় উপজেলা প্রশাসন। ঘরের ভেতরে রয়ে যায় ওইসব পরিবারের সদস্যদের খাবার, কাপড়-চোপড়, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্রও।
কোথাও একটু থাকার জায়গার ঠাঁই না পাওয়ায় বিগত ছয়টি মাস এসব হতদরিদ্র পরিবার তালাবদ্ধ আশ্রয়নের ঘরের সামনে পলি-খড় দিয়ে বেড়া দিয়ে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। শীত, ঝড়, বৃষ্টি বা বন্যা- জলোচ্ছ্বাসের মধ্যেও ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে এই দুঃসহ জীবনযাপন এখন তাদের নিত্যদিনের করুন বাস্তবতা।
ভুক্তভোগীরা বলেন, আমরা তো অশিক্ষিত মানুষ। যখন ঘরের জন্য আবেদন করেছিলাম, তখন আমাদের একটি সাদা কাগজে ‘স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতিপত্র’ দেয়া হয়েছিল, যেখানে তৎকালীন ইউএনও ও চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর ছিল। আমরা ভেবেছিলাম এটাই বুঝি আমাদের মালিকানা দলিল। এখন প্রশাসন বলছে এই কাগজ অগ্রহণযোগ্য। ফলে এখন আমরা নতুন করে আবারও সরকারের কাছে সহানুভূতির আবেদন করেছি।
স্থানীয়ভাবে উচ্ছেদের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সহানুভূতির পাশাপাশি প্রশাসনের মানবিক হস্তক্ষেপের দাবি উঠেছে। অনেকেই মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারীদের পুনর্বাসনের বিকল্প নেই। না হলে এসব পরিবার পথে বসবে।
স্থানীয় সচেতনমহল মনে করেন, সরকারি প্রকল্প থেকে উচ্ছেদ করার আগে বিকল্প ব্যবস্থা না থাকা অত্যন্ত অমানবিক। যারা এতদিন এখানে ছিলেন সরকারের উচিত, যাচাই করে হলেও প্রকৃত গৃহহীনদের নতুন করে আশ্রয় নিশ্চিত করা।
এদিকে এক সময় সরকার যাদের ঘর দিয়েছিল, এখন তাদেরই আবার সেই সরকারের কাছে ফিরে এসে বলতে হচ্ছে ‘আমাদের ঘর ফিরিয়ে দিন, আমরা কোথায় যাব?’ প্রশাসনের সদিচ্ছা আর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিই হয়তো একদিন ফিরিয়ে দেবে সেই হারানো ঘর, আর ভূমিহীন ও গৃহহীন হতদরিদ্র এ পরিবারগুলো আবারও হাঁসিমুখে বলতে পারবেন এবার আমরা সত্যিই মাথা গোজার ঠাঁই স্থায়ী পেয়েছি।