নিজস্ব প্রতিবেদক।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডাঃ শফিকুর রহমান বলেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ছাত্র-জনতা তাদের জীবন বিলিয়ে দিয়ে ফ্যাসিবাদের যাঁতাকল থেকে জাতিকে মুক্তি দিয়েছেন। তারা জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। গণঅভ্যুত্থানের পরপরই জামায়াত শহীদ ও আহত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে। এখনো আছে এবং ভবিষ্যতে থাকবে। কিন্তু ছাত্র-জনতার রক্তের উপর দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার শহীদ ও আহতদের জন্য কার্যকর তেমন উদ্যোগ নেয়নি। যা দুঃখজনক। আল্লাহ যদি সুযোগ দেন- আমরা ক্ষমতায় গেলে সবার আগে জুলাই শহীদ পরিবার ও আহতদের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিবো।
তিনি বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) বিকেলে সিলেট মহানগর জামায়াতের উদ্যোগে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের স্মরণে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপরোক্ত কথা বলেন।
তিনি বলেন, আমরা আশা করবো আগামী বছরের শুরুর দিকে দেশে একটা জাতীয় নির্বাচন হবে। তবে মৌলিক সংস্কার ও দৃশ্যমান দুয়েকটা বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সেটাও সম্ভব হবেনা। আমার আগের মতো যেনতেন কোন নির্বাচন চাইনা, হতেও দিবোনা। আমরা জানি এই সময়ে সব বিচার ও সংস্কার সম্ভব না। এজন্য পরবর্তী সরকারের উচিত বিচার ও সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া। এ নিয়ে ধানাইপানাই করলে পরিণতি ভালো হবেনা। কারণ যুবকরা পথ চিনে ফেলেছে। তারা অধিকার প্রতিষ্ঠায় ফের রাজপথে নেমে আসবে। এই সরকার ছাত্র-জনতার সরকার। তাই সরকার ভুল করলে আমরা কথা বলবো। আমরা শহীদ ও আহতদের মূল্যায়ন, গণহত্যার বিচার ও মৌলিক সংস্কার চাই।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে জামায়াত ঘোষিত টানা ৩৮দিনব্যাপী কর্মসূচীর অংশ হিসেবে উক্ত আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য ও সিলেট মহানগরী আমীর মুহাম্মদ ফখরুল ইসলামের সভাপতিত্বে, মহানগর নায়েবে আমীর ড. নূরুল ইসলাম বাবুল ও সেক্রেটারী মোহাম্মদ শাহজাহান আলীর যৌথ পরিচালনায় অনুষ্ঠানটি নগরীর পূর্ব শাহী ঈদগাহস্থ জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে জুলাই আন্দোলনে সিলেটের শহীদ পরিবারের সদস্যগণ ও বিপুল সংখ্যক আহত জুলাই যোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডাঃ শফিকুর রহমান বলেন, যাদের জীবনবাজি ভুমিকায় আমরা ফ্যাসিস্ট মুক্ত দেশ পেয়েছি, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। জুলাই আন্দোলনে আমরা কখনোই নিজেদের মাস্টারমাইন্ড দাবি করিনা। তবে আমাদের অবদান অন্যরা স্বীকার করছেন। আমরা শুধু বলি আমরা মজলুম ছিলাম, ফ্যাসিস্টদের পতনের দাবীতে ছাত্র-জনতার সাথে ছিলাম। ভবিষ্যতেও দেশ-জাতির যে কোন প্রয়োজনে আমরা পাশে থাকবো। আমরা মজলুম দল। তবে একা আমরা নই। দীর্ঘ ১৬টি বছর দেশের অনেক রাজনৈতিক দল, আলেম-উলামা ও সাংবাদিকসহ অনেকেই ফ্যাসিস্টের জুলুমের শিকার হয়েছিলেন। আমাদের উপর শুধু জুলুমই করা হয়নি, নিষিদ্ধও করা হয়েছিল। ছাত্ররা ডাক দিয়েছিল। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিলাম। বিজয় নিশ্চিত হয়েছে। আমরা সকল শহীদ ও আহতদের পাশে ছুটে গেছি। এখনো আছি, ভবিষ্যতেও থাকবো। আমরা সকল শহীদ ও আহতদের পরিবারের কাছে চিরঋণী।
তিনি আরও বলেন, আমরা জুলুম-নিপীড়নের শিকার হয়েছি, দেশ ছাড়িনি। কোনদিন ছাড়বোনা। বিগত সময়ে জুলুমের মাত্রা দেখে কোন কোন ব্যক্তি ও দেশ হেকমতের অংশ হিসেবে আমাদেরকে আশ্রয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। আমরা বলেছিলাম নিরাপত্তা দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ। এই দেশটা আমাদের, যতদিন আল্লাহ হায়াত দেন এদেশেই ইনসাফভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের চেষ্টা করে যাবো। ২ হাজার ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশ কী এখন নিরাপদ? এখন কি কোন-খারাবি হচ্ছেনা, অন্যায় অবিচার হচ্ছেনা। আমরা বলেছি জামায়াতের প্রতিটা নেতৃত্বের ব্যাপারে আমাদের কড়া নজরদারি রয়েছে। আমরা মানুষ, তাই ভুলের ঊর্ধ্বে নই। কিন্তু দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, নারীদের ইজ্জত কেড়ে নেয়া আমাদের সংস্কৃতি নয়। যেসব দল নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেনা, তাদের কাছে জনগণ নিরাপদ নয়। তাই সবাইকে বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে। আমরা বার বার বলছি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে আমরা বিজয়ী হয়েছি, এবার দুর্নীতি-লুটপাট ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সংগ্রামেও বিজয়ী হতে হবে।
আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য, সিলেট জেলা আমীর ও সিলেট-১ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী মাওলানা হাবিবুর রহমান।
জামায়াত নেতা শাহজালাল শরীফের কুরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সুচীত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, সিলেট জেলা জামায়াতের সেক্রেটারী ও জৈন্তাপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, হবিগঞ্জ জেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা কাজী মখলিছুর রহমান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস সিলেট মহানগর সভাপতি মাওলানা গাজী রহমতুল্লাহ, ৫ আগস্ট কোতোয়ালী থানায় নিহত পংকজ করের পিতা নিখিল চন্দ্র কর, শহীদ শাহজাহানের ভাই পারভেজ মিয়া, শহীদ রায়হান উদ্দিনের ভাই সিয়াম উদ্দিন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিলেট জেলার সমন্বয়ক আবু সাঈদ। ইসলামী সংগীত পরিবেশন করেন দিশারী শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীবৃন্দ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের মাগফেরাত ও আহতদের সুস্থতা এবং মাইলস্টোন কলেজ ট্রাজেডিতে নিহতদের মাগফেরাত ও আহতদের সুস্থতা এবং দেশ জাতির মঙ্গল কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন আমীরে জামায়াত ডাঃ শফিকুর রহমান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমীরে জামায়াত বলেন, ৫ আগস্ট আমরা বলেছিলাম ব্যক্তিগত প্রতিশোধ না নেয়ার জন্য। বিভিন্ন দেশে বিপ্লবের পর অনেক অরাজকতা হয়। সেই তুলনায় আমাদের তেমন কিছুই হয়নি। এরপরও কতিপয় মিডিয়া ও একটি দেশ নানা অপপ্রচার চালিয়েছিল। আজ তারা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। তবে তাদের ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়নি। তারা দেশকে ও তরুণ নেতৃত্বকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করছে। এ ব্যাপারে ছাত্র-জনতাকে সজাগ ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া ৭০ ভাগ মানুষ ছিল দিন আনে দিন খায়, অর্থাৎ শ্রমজীবী মানুষ। তাদের দেওয়ার মতো তেমন কিছুই ছিলনা। তাই হয়তো আল্লাহর দেয়া জীবনটা জাতির জন্য বিলিয়ে দিয়েছে। আমরা সবাইকে বলেছি প্রয়োজন হলে আমাদের স্মরণ করবেন। শুনতে দেরি হবে কিন্তু আমাদের আসতে দেরি হবেনা। ইতিহাস অমলিন। মাঝে মাঝে ইতিহাসও মলিন হয়। তাই আমরা শহীদদের স্মরণীয় করতে ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। অনেক যাচাই বাছাই করে প্রথম পর্যায়ে শহীদ পরিচিতি নিয়ে ১০টি খন্ড প্রকাশ করেছি। আরো ২টা খন্ড তৈরী হয়েছে। শুধু তাই নয়, আমরা আহতদের নিয়েও ২টি খন্ড করেছি। এটা কমপক্ষে ৫০ খন্ড হবে। আমরা ইতিহাস লিপিবদ্ধ করছি। অথচ এটা দলের কাজ ছিলনা। সরকারের কাজ ছিল। জাতির শ্রেষ্ট সন্তানদের ত্যাগকে সমুন্নত রাখতে আমরা এই উদ্যোগ নিয়েছি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসার জন্য আমরা জামায়াতের পক্ষ থেকে ৩টা দেশকে অনুরোধ করেছিলাম। ২টা দেশ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম নিয়ে দেশে এসেছিলো। অথচ সরকার বললে ৫০টা দেশ আসতো।
ডাঃ শফিকুর রহমান বলেন, আমি চা বাগানের মানুষদের সাথে বসেছি। তারা কী মানুষ নয়? তাদের ন্যায্য দাবীগুলো মালিকদের উপর ছেড়ে দেয়া হয়। আর মালিকগণ তাদেরকে মানুষই মনে করেনা। দেশের সম্ভাবনাময় চা শিল্পকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর উদ্যোগ নেই। সব জায়গায় সিন্ডিকেট। যারা চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট করে তারা ভিক্ষুকের চেয়েও খারাপ। আমি একথা কোন দলকে বলছিনা। কেউ যদি ঐ চরিত্রের হয়, আর বিষয়টি নিজের দিকে টেনে নেয়, সেখানে আমার কিছুই করার নেই।
তিনি বলেন, আমরা বিদেশে গেলে সবাই আমাদের পরামর্শ দেয়। আমাদের সম্ভাবনা আছে কেবল দুর্নীতি বন্ধ হলেই দেশ এগিয়ে যাবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে কিছু পুস্তক, সার্টিফিকেট ও ডিগ্রি নির্ভর করা হয়েছে। নিজ দেশেই এর সঠিক মূল্যায়ন নাই, বহির্বিশ্বে তো মুল্য নেই। আমাদের প্রবাসীরা বিদেশে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে কিন্তু কাক্সিক্ষত রুজি করতে পারছেনা। কিন্তু তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে বিদেশে পাঠালে রুজিও বেশি হতো, সঠিক মুল্যায়ন হতো। আমরা তরুণ-তরুণীদের কারিগরি শিক্ষায় মানবসম্পদে পরিণত করতে চাই। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা কারো খোদাত্ব, বড় ভাই সুলভ আচরণ মেনে নিবোনা। দেশ যত ছোটই হোক মর্যাদার ভিত্তিতে বৈদেশিক সম্পর্ক নিশ্চিত করা হবে।
প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে আমরা অগ্রাধিকার দিবো। তবে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কারো হস্তক্ষেপ মেনে নেয়া হবেনা। মানুষের মুক্তির জন্য আমরা লড়াই চালিয়ে যাবো। সততা, স্বচ্ছতা ও দেশপ্রেমের ভিত্তিতে আমাদের কর্মপন্থা অব্যাহত থাকবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, জুলাই আন্দোলন হঠাৎ করেই চলে আসেনি। এর আগে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকেই এর সূচনা হয়েছিল। ফ্যাসিস্ট সরকার সেখানেও নির্মম ভাবে হস্তক্ষেপ করেছিল। ২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনেও সরকার নির্মমতা ও গণহত্যা চালায়। তখন গণহত্যার বিরুদ্ধে ছাত্রদের পাশাপাশি দেশপ্রেমিক জনতা রাস্তায় নেমে এসেছিল। ফলে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন নিশ্চিত হয়।
তিনি আরও বলেন, সিলেট নগরীতে জুমআর নামাযের পরপরই পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিক তুরাবকে হত্যা করা হয়। সারাদেশে ছাত্র-জনতার উপর নৃশংস গণহত্যা চালানো হয়েছে। জুলাই আন্দোলনের শহীদ-আহতরা জাতির সম্পদ। শুরু থেকেই জামায়াত শহীদের পরিবার ও আহতদের পাশে রয়েছে। আমরা সরকারকে বলেছি শহীদদের পরিবার থেকে কমপক্ষে একজনকে চাকুরী ও আহতদের সম্মানজনক একটি পেশায় পুনর্বাসন করা হোক। জুলাইয়ে আমরা প্রাথমিক বিজয় পেয়েছি। চূড়ান্ত বিজয় আসবে সকলে মিলে মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের মাধ্যমে।
সভাপতির বক্তব্যে সিলেট মহানগর জামায়াতের আমীর মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবার ও আহতদের পাশে আমরা ছিলাম, আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকবো। সিলেটের কেউ যদি সরকারের শহীদ ও আহতদের তালিকায় তালিকাভুক্ত না হয়ে থাকেন আমাদের সাথে যোগাযোগ করলে আমরা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবো।