ঢাকা , শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
গফরগাঁও মদের ডিপোতে মোবাইল কোট পরিচালিত কালীগঞ্জে গরু চোর চক্রের ৭ সদস্য গ্রেপ্তার, চোরাই গরু উদ্ধার সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান তালুকদারের ইন্তিকালে ড. মাওলানা আব্দুস সামাদের শোক আজও বাবার অপেক্ষায় থাকে শহীদ জসিম উদ্দিনের দুই শিশু সন্তান, স্ত্রীর গর্ভে রেখে যাওয়া শহীদ রনি’র মেয়ে “রোজা” বেড়ে উঠছে বাবাকে ছাড়া ! তুরাবসহ সকল শহিদ আমাদের প্রেরনা- ফয়সল চৌধুরী সিলেট-৬ রাজশাহীর পবায় বিনামূল্যে গাছের চাড়া বিতরণ  নকলায় তারেক জিয়ার প্রজন্ম দলের বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ ৫ দিন পর নিখোঁজ সোহাগের লাশ মিলল নদীতে। মনপুরায় পুলিশের অভিযানে ইউপি চেয়ারম্যান সহ আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের ৪ নেতা আটক। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ছবি অবমাননার প্রতিবাদে গৌরীপুরে কৃষকদলের বিক্ষোভ সমাবেশ

আজও বাবার অপেক্ষায় থাকে শহীদ জসিম উদ্দিনের দুই শিশু সন্তান, স্ত্রীর গর্ভে রেখে যাওয়া শহীদ রনি’র মেয়ে “রোজা” বেড়ে উঠছে বাবাকে ছাড়া !

আজও বাবার অপেক্ষায় থাকে শহীদ জসিম উদ্দিনের দুই শিশু সন্তান, স্ত্রীর গর্ভে রেখে যাওয়া শহীদ রনি’র মেয়ে “রোজা” বেড়ে উঠছে বাবাকে ছাড়া !

রাহাদ সুমন, বিশেষ প্রতিনিধি। রাজধানীতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শহীদ বরিশালের বানারীপাড়ার হাফেজ মাওলানা জসিম উদ্দিন  ও শহীদ আল-আমিন রনি’র বৃদ্ধা মা.স্ত্রী ও শিশু সন্তানদের চোখের জলে কেটে গেছে একটি বছর।

গত বছরের ১৮ জুলাই হাফেজ মাওলানা জসিম উদ্দিন ও ১৯ জুলাই আল-আমিন রনি’র বুলেটবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু তাদের দুজনের পরিবারে ঘোর অমানিশার অন্ধকার নামিয়ে দেয়। আজও জসিম উদ্দিনের অবুঝ মেয়ে জান্নাত ও ছেলে সাইফ বাবার আগমনী পথের দিকে তাকিয়ে তাকে। তাদের অপেক্ষার শেষ হয়না। দিন, মাস পেরিয়ে বছর হয়ে গেলেও প্রিয় বাবা আর ফিরে আসেননা।

আর কখনও, সন্তানদের জন্য ঢাকা থেকে নতুন পোশাক, কসমেটিক্স, খেলনা সামগ্রী ও নানা খাবার নিয়ে বাড়িতে আসবেন না জসিম। কারন তিনি যে চির অচেনার দেশে চিরতরে পাড়ি জমিয়েছেন। জসিমকে ছাড়া এবারের ঈদ-কোরবানির আনন্দ ভেসে গেছে স্বজনদের চোখের জলে। হার্টের রোগী বৃদ্ধা মা মেহেরুন্নেছা বেগম নাড়ী ছেড়া ধন ছেলে জসিমকে হারিয়ে শোকে পাগলপ্রায়। ছেলের কথা মনে করে প্রতিনিয়ত চোখের জলে ভাসেন তিনি।

বিলাপ করে তিনি বলেন, “গত একটা বছর পোলাডার প্রিয় মুখটা দেহিনা। ওর মায়াবী কন্ঠে মা ডাক হুনিনা। আর কোন দিন ও মোরে মা কইয়া ডাক দেবে না। আল্লাহ যেন মোর বাপজানরে বেহেস্তের উচ্চ মাকামে স্থান দেন। বেহেস্তেও যেন আবার ওর দেহা পাই একসঙ্গে সবাই থাকতে পারি। নামাজসহ সবসময় আল্লাহর দরবারে এই দোয়া করি।” এই অসুস্থ প্রাণপ্রিয় মাকে দেখভাল করতেই জসিম উদ্দিন তার স্ত্রী সন্তানকে গ্রামের বাড়িতে রেখেছিলেন। জসিম উদ্দিনের স্ত্রী সুমি আক্তার বলেন, স্বামীকে হারিয়ে আমাদের সব আনন্দ চিরকালের জন্য শেষ হয়ে গেছে।

বাবার জন্য ছেলে-মেয়ে দুটি হাহাকার করছে। ছোট্ট ছেলেটি বাবার জন্য কাঁদছে আবার হাত দিয়ে আমার (মায়ের) চোখের জল মুছিয়ে দেয়। তাকে ছাড়া আমরা বড় আসহায়। ওদের বাবার শূণ্যতা পূরণ করার সাধ্য আমার নেই। প্রতিদিন ওরা বাবার কথা মনে করে কাঁদে। অপেক্ষা করে এই বুঝি বাবা আসছেন। সন্তানদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল ওদের বাবার। এখন সেই বাবাহারা সন্তান দুটিকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করে তুলতে সবার সহযোগিতা ও দোয়া চাই। সময় কত দ্রুত ফুরিয়ে যায়। চোখের জলে তাকে হারানোর এক বছর হয়ে গেলো।

মহান আল্লাহ যেন আমার স্বামীকে জান্নাতবাসী করেন, সবার কাছে এই দোয়া চাই। উপজেলার চাখার ওয়াজেদ মেমোরিয়াল বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস জান্নাত (১১) কান্নাভেজা কন্ঠে বলেন,বাবা বাড়িতে আসলে আমাদের দুই ভাই-বোনের জন্য বিভিন্ন খেলনা, চকলেটসহ খাবার ও পোশাক নিয়ে আসতেন। আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। সেই প্রিয় বাবা আর কোন দিন আসবেন না, আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরবেন না। বাবাকে ছাড়াই আমাদের এতিমের মত জীবন কাটাতে হবে। কাকে বাবা বলে ডাকবো আমরা। জসিম উদ্দিনের রেখে যাওয়া দেড় বছর বয়সী ছেলে মোঃ জামিল উদ্দিন সাইফের বর্তমান বয়স দুই বছর ৬ মাস। সেই ছোট্ট সাইফ সবার মাঝে বাবাকে আজও খুঁজে ফিরছে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৮ জুলাই দুপুরে ঢাকার উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরে কোটা আন্দোলনকারী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান হাফেজ মাওলানা জসিম উদ্দিন (৩৫)। ওই দিন রাতেই বরিশালের বানারীপাড়ার পূর্ব সলিয়াবাকপুর গ্রামের বাড়িতে তার মরদেহ নিয়ে আসা হয়। পরের দিন ১৯ জুলাই সকালে বাড়ির পাশে তার এক সময়ের বিদ্যাপীঠ পূর্ব সলিয়াবাকপুর দারুল উলুম হোসাইনিয়া কওমি কেরাতিয়া মাদ্রাসা মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। তিনি ওই গ্রামের মৃত আব্দুল মান্নান হাওলাদের ছেলে।

জানা গেছে, গত প্রায় ১৫ বছর ধরে ঢাকায় থাকতেন হাফেজ মাওলানা জসিম উদ্দিন। উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরে এমএসএ ওয়ার্কশপে চাকরি করতেন। ঘটনার দিন ৭ নম্বর সেক্টরে ফরহাদ অটো পার্টসের দোকানে যান মাইক্রোবাসের পার্টস কিনতে। সেখান থেকে নিজ ওয়ার্কশপে ফিরতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।

অপরদিকে, স্ত্রীর গর্ভে সন্তান রেখে জুলাই গণঅভূত্থানে শহীদ হন বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের পূর্ব বেতাল গ্রামের আল-আমিন রনি। তার মৃত্যুর প্রায় চার মাস পরে ৪ নভেম্বর বানারীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে স্ত্রী মিম আক্তার এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। নবজাতকের নাম রাখা হয় “রোজা”। বাবা আল- আমিন রনি ও মেয়ে রোজার ভাগ্য যে কতটা নির্মম।

রনি বাবা হয়েছেন, ঠিকই কিন্তু সন্তানের মুখটা দেখতে পারলেন না। মেয়ে রোজাও উঠতে পারলো না বাবার কোলে,দেখতে পারলো না বাবার মুখ। পেল না বাবার অপার -স্নেহ-ভালোবাসা। প্রায় ৯ মাস বয়সী রোজার জীবন কাটছে বাবাকে ছাড়া। সবার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে শিশু রোজা হয়তো ওর বাবাকেই খুঁজে ফেরে। নির্মম বুলেট বাবাকে তার জন্মের আগেই না ফেরার দেশের যাত্রী করে দিয়েছে। রনিকে হারিয়ে তাদের গোটা পরিবারে গত ঈদ ও কোরবানির আনন্দ ভেসে গেছে চোখের জলে। রনিকে হারিয়ে তার মা মেরিনা বেগম ও শতবর্ষী দাদি মরিয়ম বেগমের কান্না-বিলাপ আজও থামেনি। ঘরের সামনে রনি’র কবরের কাছে গিয়ে তারা প্রতিদিনই চোখের জলে ভাসেন। তার জান্নাত কামনায় মহান আল্লাহর দরবারে হাত তুলে ফরিয়াদ করেন।

মা মেরিনা বেগম কান্না করে বলেন, নাড়ী ছেড়া ধন রনি’র মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের সব হাসি-আনন্দ চিরতরে হারিয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, ছেলেটার কত স্বপ্ন ছিল বাবা ডাক শুনবে। সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়িয়ে মানুষের মতো মানুষ করবে। আমার বুকের মানিকের সেই স্বপ্ন আর পূরণ হইল না। সন্তানের মুখটা দেখা হল না।

সবাইকে ছেড়ে চলে গেল আমার বুকের মানিক! বিয়ের এক বছর তিন মাসের মাথায় বিধবা হওয়া স্ত্রী মিম আক্তার জানান, ছেলে হলে “আজান” আর মেয়ে হলে “রোজা” নাম রাখার ইচ্ছে ছিলো স্বামী আল আমিন রনির। তার ইচ্ছে অনুযায়ী মেয়ের নাম রাখা হয় রোজা আক্তার। তবে স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই অথৈ সাগরে ভাসছেন তিনি। এখন নিজের পাশাপাশি সন্তানকে নিয়ে অসহায় বাবার পরিবারে বোঝা হতে চান না মিম।

তিনি বলেন, স্বামীর সঙ্গে জীবনের সব আনন্দও হারিয়ে গেছে। বাবাহারা এই সন্তানকে বড় করে তোলা এখন জীবন যুদ্ধে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সন্তানের মাঝেই খুঁজে পাবো প্রিয় স্বামীর ছায়া। এবছর ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে নিজে সাবলম্বি হয়ে মেয়েকে মানুষের মত মানুষ করে তোলাই এখন জীবনের প্রধান লক্ষ্য।

নিহত রনির শ্বশুর চাখার বাজারের ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ী মো. কামাল হোসেন মাঝি বলেন, মিম এইচএসসি পাস করেছে। এবছর ডিগ্রিতে ভর্তি হবে।  মেয়েকে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।

প্রসঙ্গত, আল-আমিন রনি (২৪) গতবছরের ১৯ জুলাই ঢাকার মহাখালীতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পরদিন ২০ জুলাই তাঁর মরদেহ মা মেরিনা বেগমসহ স্বজনরা বাড়িতে নিয়ে আসেন। বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের পূর্ব বেতাল গ্রামে তাদের বাড়ি। আল-আমিন রনি মহাখালীর মাল্টিব্র্যান্ড ওয়ার্কশপে কাজ করতেন। বাবা দুলাল হাওলাদার মারা গেছেন করোনাকালে। মা মেরিনা বেগম, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মিম ও ছোট ভাই রহিমকে নিয়ে ঢাকার মহাখালী সাততলা বাউন্ডারি বস্তি এলাকায় থাকতেন রনি। রনির আয় দিয়ে চলত চার সদস্যের এই পরিবার।

ঘটনার, দিন ১৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মায়ের কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে মহাখালীর বস্তি এলাকার বাসা থেকে বের হন রনি। ওই দিন বিকেল ৫টার দিকে মহাখালী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সংঘর্ষের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। রাত ৮টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে তাঁর মরদেহ শনাক্ত করেন মা। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরের দিন ২০ জুলাই বানারীপাড়ার পূর্ব বেতাল গ্রামে এনে রাত ১টায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবার পাশে তাকে চির নিন্দ্রায় শায়িত করা হয়।

আপলোডকারীর তথ্য

news room

জনপ্রিয় সংবাদ

গফরগাঁও মদের ডিপোতে মোবাইল কোট পরিচালিত

আজও বাবার অপেক্ষায় থাকে শহীদ জসিম উদ্দিনের দুই শিশু সন্তান, স্ত্রীর গর্ভে রেখে যাওয়া শহীদ রনি’র মেয়ে “রোজা” বেড়ে উঠছে বাবাকে ছাড়া !

আপডেট সময় ১২:০৩:২৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫
রাহাদ সুমন, বিশেষ প্রতিনিধি। রাজধানীতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শহীদ বরিশালের বানারীপাড়ার হাফেজ মাওলানা জসিম উদ্দিন  ও শহীদ আল-আমিন রনি’র বৃদ্ধা মা.স্ত্রী ও শিশু সন্তানদের চোখের জলে কেটে গেছে একটি বছর।

গত বছরের ১৮ জুলাই হাফেজ মাওলানা জসিম উদ্দিন ও ১৯ জুলাই আল-আমিন রনি’র বুলেটবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু তাদের দুজনের পরিবারে ঘোর অমানিশার অন্ধকার নামিয়ে দেয়। আজও জসিম উদ্দিনের অবুঝ মেয়ে জান্নাত ও ছেলে সাইফ বাবার আগমনী পথের দিকে তাকিয়ে তাকে। তাদের অপেক্ষার শেষ হয়না। দিন, মাস পেরিয়ে বছর হয়ে গেলেও প্রিয় বাবা আর ফিরে আসেননা।

আর কখনও, সন্তানদের জন্য ঢাকা থেকে নতুন পোশাক, কসমেটিক্স, খেলনা সামগ্রী ও নানা খাবার নিয়ে বাড়িতে আসবেন না জসিম। কারন তিনি যে চির অচেনার দেশে চিরতরে পাড়ি জমিয়েছেন। জসিমকে ছাড়া এবারের ঈদ-কোরবানির আনন্দ ভেসে গেছে স্বজনদের চোখের জলে। হার্টের রোগী বৃদ্ধা মা মেহেরুন্নেছা বেগম নাড়ী ছেড়া ধন ছেলে জসিমকে হারিয়ে শোকে পাগলপ্রায়। ছেলের কথা মনে করে প্রতিনিয়ত চোখের জলে ভাসেন তিনি।

বিলাপ করে তিনি বলেন, “গত একটা বছর পোলাডার প্রিয় মুখটা দেহিনা। ওর মায়াবী কন্ঠে মা ডাক হুনিনা। আর কোন দিন ও মোরে মা কইয়া ডাক দেবে না। আল্লাহ যেন মোর বাপজানরে বেহেস্তের উচ্চ মাকামে স্থান দেন। বেহেস্তেও যেন আবার ওর দেহা পাই একসঙ্গে সবাই থাকতে পারি। নামাজসহ সবসময় আল্লাহর দরবারে এই দোয়া করি।” এই অসুস্থ প্রাণপ্রিয় মাকে দেখভাল করতেই জসিম উদ্দিন তার স্ত্রী সন্তানকে গ্রামের বাড়িতে রেখেছিলেন। জসিম উদ্দিনের স্ত্রী সুমি আক্তার বলেন, স্বামীকে হারিয়ে আমাদের সব আনন্দ চিরকালের জন্য শেষ হয়ে গেছে।

বাবার জন্য ছেলে-মেয়ে দুটি হাহাকার করছে। ছোট্ট ছেলেটি বাবার জন্য কাঁদছে আবার হাত দিয়ে আমার (মায়ের) চোখের জল মুছিয়ে দেয়। তাকে ছাড়া আমরা বড় আসহায়। ওদের বাবার শূণ্যতা পূরণ করার সাধ্য আমার নেই। প্রতিদিন ওরা বাবার কথা মনে করে কাঁদে। অপেক্ষা করে এই বুঝি বাবা আসছেন। সন্তানদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল ওদের বাবার। এখন সেই বাবাহারা সন্তান দুটিকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করে তুলতে সবার সহযোগিতা ও দোয়া চাই। সময় কত দ্রুত ফুরিয়ে যায়। চোখের জলে তাকে হারানোর এক বছর হয়ে গেলো।

মহান আল্লাহ যেন আমার স্বামীকে জান্নাতবাসী করেন, সবার কাছে এই দোয়া চাই। উপজেলার চাখার ওয়াজেদ মেমোরিয়াল বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস জান্নাত (১১) কান্নাভেজা কন্ঠে বলেন,বাবা বাড়িতে আসলে আমাদের দুই ভাই-বোনের জন্য বিভিন্ন খেলনা, চকলেটসহ খাবার ও পোশাক নিয়ে আসতেন। আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। সেই প্রিয় বাবা আর কোন দিন আসবেন না, আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরবেন না। বাবাকে ছাড়াই আমাদের এতিমের মত জীবন কাটাতে হবে। কাকে বাবা বলে ডাকবো আমরা। জসিম উদ্দিনের রেখে যাওয়া দেড় বছর বয়সী ছেলে মোঃ জামিল উদ্দিন সাইফের বর্তমান বয়স দুই বছর ৬ মাস। সেই ছোট্ট সাইফ সবার মাঝে বাবাকে আজও খুঁজে ফিরছে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৮ জুলাই দুপুরে ঢাকার উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরে কোটা আন্দোলনকারী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান হাফেজ মাওলানা জসিম উদ্দিন (৩৫)। ওই দিন রাতেই বরিশালের বানারীপাড়ার পূর্ব সলিয়াবাকপুর গ্রামের বাড়িতে তার মরদেহ নিয়ে আসা হয়। পরের দিন ১৯ জুলাই সকালে বাড়ির পাশে তার এক সময়ের বিদ্যাপীঠ পূর্ব সলিয়াবাকপুর দারুল উলুম হোসাইনিয়া কওমি কেরাতিয়া মাদ্রাসা মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। তিনি ওই গ্রামের মৃত আব্দুল মান্নান হাওলাদের ছেলে।

জানা গেছে, গত প্রায় ১৫ বছর ধরে ঢাকায় থাকতেন হাফেজ মাওলানা জসিম উদ্দিন। উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরে এমএসএ ওয়ার্কশপে চাকরি করতেন। ঘটনার দিন ৭ নম্বর সেক্টরে ফরহাদ অটো পার্টসের দোকানে যান মাইক্রোবাসের পার্টস কিনতে। সেখান থেকে নিজ ওয়ার্কশপে ফিরতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।

অপরদিকে, স্ত্রীর গর্ভে সন্তান রেখে জুলাই গণঅভূত্থানে শহীদ হন বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের পূর্ব বেতাল গ্রামের আল-আমিন রনি। তার মৃত্যুর প্রায় চার মাস পরে ৪ নভেম্বর বানারীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে স্ত্রী মিম আক্তার এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। নবজাতকের নাম রাখা হয় “রোজা”। বাবা আল- আমিন রনি ও মেয়ে রোজার ভাগ্য যে কতটা নির্মম।

রনি বাবা হয়েছেন, ঠিকই কিন্তু সন্তানের মুখটা দেখতে পারলেন না। মেয়ে রোজাও উঠতে পারলো না বাবার কোলে,দেখতে পারলো না বাবার মুখ। পেল না বাবার অপার -স্নেহ-ভালোবাসা। প্রায় ৯ মাস বয়সী রোজার জীবন কাটছে বাবাকে ছাড়া। সবার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে শিশু রোজা হয়তো ওর বাবাকেই খুঁজে ফেরে। নির্মম বুলেট বাবাকে তার জন্মের আগেই না ফেরার দেশের যাত্রী করে দিয়েছে। রনিকে হারিয়ে তাদের গোটা পরিবারে গত ঈদ ও কোরবানির আনন্দ ভেসে গেছে চোখের জলে। রনিকে হারিয়ে তার মা মেরিনা বেগম ও শতবর্ষী দাদি মরিয়ম বেগমের কান্না-বিলাপ আজও থামেনি। ঘরের সামনে রনি’র কবরের কাছে গিয়ে তারা প্রতিদিনই চোখের জলে ভাসেন। তার জান্নাত কামনায় মহান আল্লাহর দরবারে হাত তুলে ফরিয়াদ করেন।

মা মেরিনা বেগম কান্না করে বলেন, নাড়ী ছেড়া ধন রনি’র মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের সব হাসি-আনন্দ চিরতরে হারিয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, ছেলেটার কত স্বপ্ন ছিল বাবা ডাক শুনবে। সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়িয়ে মানুষের মতো মানুষ করবে। আমার বুকের মানিকের সেই স্বপ্ন আর পূরণ হইল না। সন্তানের মুখটা দেখা হল না।

সবাইকে ছেড়ে চলে গেল আমার বুকের মানিক! বিয়ের এক বছর তিন মাসের মাথায় বিধবা হওয়া স্ত্রী মিম আক্তার জানান, ছেলে হলে “আজান” আর মেয়ে হলে “রোজা” নাম রাখার ইচ্ছে ছিলো স্বামী আল আমিন রনির। তার ইচ্ছে অনুযায়ী মেয়ের নাম রাখা হয় রোজা আক্তার। তবে স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই অথৈ সাগরে ভাসছেন তিনি। এখন নিজের পাশাপাশি সন্তানকে নিয়ে অসহায় বাবার পরিবারে বোঝা হতে চান না মিম।

তিনি বলেন, স্বামীর সঙ্গে জীবনের সব আনন্দও হারিয়ে গেছে। বাবাহারা এই সন্তানকে বড় করে তোলা এখন জীবন যুদ্ধে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সন্তানের মাঝেই খুঁজে পাবো প্রিয় স্বামীর ছায়া। এবছর ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে নিজে সাবলম্বি হয়ে মেয়েকে মানুষের মত মানুষ করে তোলাই এখন জীবনের প্রধান লক্ষ্য।

নিহত রনির শ্বশুর চাখার বাজারের ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ী মো. কামাল হোসেন মাঝি বলেন, মিম এইচএসসি পাস করেছে। এবছর ডিগ্রিতে ভর্তি হবে।  মেয়েকে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।

প্রসঙ্গত, আল-আমিন রনি (২৪) গতবছরের ১৯ জুলাই ঢাকার মহাখালীতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পরদিন ২০ জুলাই তাঁর মরদেহ মা মেরিনা বেগমসহ স্বজনরা বাড়িতে নিয়ে আসেন। বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের পূর্ব বেতাল গ্রামে তাদের বাড়ি। আল-আমিন রনি মহাখালীর মাল্টিব্র্যান্ড ওয়ার্কশপে কাজ করতেন। বাবা দুলাল হাওলাদার মারা গেছেন করোনাকালে। মা মেরিনা বেগম, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মিম ও ছোট ভাই রহিমকে নিয়ে ঢাকার মহাখালী সাততলা বাউন্ডারি বস্তি এলাকায় থাকতেন রনি। রনির আয় দিয়ে চলত চার সদস্যের এই পরিবার।

ঘটনার, দিন ১৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মায়ের কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে মহাখালীর বস্তি এলাকার বাসা থেকে বের হন রনি। ওই দিন বিকেল ৫টার দিকে মহাখালী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সংঘর্ষের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। রাত ৮টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে তাঁর মরদেহ শনাক্ত করেন মা। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরের দিন ২০ জুলাই বানারীপাড়ার পূর্ব বেতাল গ্রামে এনে রাত ১টায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবার পাশে তাকে চির নিন্দ্রায় শায়িত করা হয়।