ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
জিয়াকে কটাক্ষ ও সারা‌দে‌শে আইন শৃঙ্খলার অবন‌তির প্রতিবা‌দে ভোলায় যুবদলের বি‌ক্ষোভ মি‌ছিল। শোকের নীরবতা ছুঁয়ে গেল কালীগঞ্জ ‘জুলাই অনির্বাণ’ প্রদর্শনীতে অশ্রু জয় করলো হৃদয় জুলাই বিপ্লব আমাদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে শিখিয়েছে-ইআবি ভিসি বুড়িচংয়ে শহীদদের স্মরণে গ্রাফিতি ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত কুমিল্লার দেবিদ্বারে ঘরে ঢুকে এক গৃহবধূকে হত্যা আজকের এই দিনে কোঠা বিরোধিদের বিরুদ্ধে ফুলবাড়ীতে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা মাদক ব্যবসায়ী ২জন বিপুল পরিমান ইয়াবা ট্যাবলেট সহ গ্রেফতার।  নিজ বাড়িতে জায়গা হলো না মায়ের ছেলের অত্যাচারে আজ বাড়ির বাহিরে আটক অবস্থায় আছে। আইনশৃঙ্খলা অবনতির প্রতিবাদে পটুয়াখালীতে যুবদলের বিক্ষোভ বিপুল পরিমান গাঁজাসহ ০১ জন মাদক ব্যবসায়ী কে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

হবিগঞ্জ কারাগারে রায়হীন কানু মিয়ার ৩০ বছর

হবিগঞ্জ কারাগারে রায়হীন কানু মিয়ার ৩০ বছর

লিটন পাঠান, হবিগঞ্জ প্রতিনিধি : কানু মিয়ার গল্প একসময় মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় নিজের মাকে হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন কানু মিয়া।

এরপর, আদালতের সাজার কোনো রায় ছাড়াই টানা তিন দশক কেটেছে কারাগারে। দুই দশক আগে মামলার কার্যক্রম স্থগিত হলেও মুক্তি মেলেনি তার। অবশেষে জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তার নজরে এলে শুরু হয় আইনি তৎপরতা। আদালতের নির্দেশে দীর্ঘ ৩০ বছরের বন্দিজীবনের অবসান ঘটে কানু মিয়ার। মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) দুপুরে হবিগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। মুক্তি পাওয়া কানু মিয়ার বয়স এখন ৫০ বছর।

তার বাড়ি হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার সিংহগ্রামে। বাবার নাম চিনি মিয়া (মৃত)। সরেজমিনে কানু মিয়ার বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, মাত্র চার শতক জমির ওপর ছোট চারটি টিনের ঘরে তার তিন ভাই পরিবার নিয়ে গাদাগাদি করে থাকেন। বাড়ির উঠানে বসে থাকা কানু মিয়ার পাশে হাতপাখা করছেন ভাতিজি জোসনা বেগম।

আপাশের লোকজনও ফিরে পাওয়া স্বজনকে ঘিরে কথা বলছেন। শদুই মায়ের ঘরে সাত ভাইবোনের মধ্যে কানু মিয়া ষষ্ঠজন। দরিদ্রতা কারণে পরিবার তার চিকিৎসাও করাতে পারেনি। এখনও মাঝেমধ্যে অসংলগ্ন কথা বলেন কানু।

পরিবার বলছে, চিকিৎসা প্রয়োজন, কিন্তু সামর্থ্য নেই। বড় ভাই নসু মিয়া জানান, কানু ঢাকায় কাজ করত, তখন বয়স ২৫। জ্বরে অসুস্থ হয়ে পড়েন এক সময়। পরে তার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এরপর কাজ ছেড়ে বাড়ি ফেরেন কানু। ১৯৯৫ সালের ২৫ মে হঠাৎ ঘরে ঢুকে মায়ের গলায় কোদাল দিয়ে কোপ দেন তিনি। হাসপাতালে নেওয়ার পথে মা মারা যান। পরে পুলিশ তাকে আটক করে। তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে তখন কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি। পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। প্রথমে সিলেট, পরে হবিগঞ্জ কারাগারে রাখা হয় কানু মিয়াকে। কারাগারে যাওয়ার দশ বছর পর এক মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দির মাধ্যমে তারা জানতে পারেন কানু জীবিত। বিশ বছর পর তারা ভাইকে একবার দেখে এসেছিলেন তিনি আরও বলেন।

কানুরে এখন আমরা সবাই মিল্লা খেয়াল রাখরাম আমরার ভাই বইল্লা খতা, ফালাইতাম তো ফারতাম না। তবে চিখিৎসা সাহায্য দরখার আসে। রাতে আমার সাইডে ঘুমায়, কিন্তু আমার তো ডর লাগে। কানুকে এখন আমরা সবাই মিলে সেবা করছি। ভাই বলে কথা, ফেলে দিতে পারি না। তবে চিকিৎসায় সহযোগিতা দরকার। রাতে আমার পাশে ঘুমায়, কিন্তু ঘুমাতে ভয় লাগে। ৩০ বছরের বন্দী জীবন সম্পর্কে কানু মিয়ার কাছ থেকে জানার চেষ্টা করে বাংলানিউজ। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কথা বলানো যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে নিজেই কথা বলে ওঠেন।

তিনি বলেন, ‘ভালা লাগছে, আমেরিকাত থাকিয়া আইছি তাই ভালা লাগতাছে।’ এরপর কিছু অসংলগ্ন কথা বলেন। মায়ের মুখ এখনও মনে আছে বলেও জানান। কানুর ভাতিজি জোসনা তার চিকিৎসার জন্য সবার সহযোগিতা চেয়েছেন।

স্থানীয় মানবাধিকারকর্মী সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা সহসভাপতি বাহার উদ্দিন বলেন, জানতামই না গ্রামে এমন কেউ বিনা বিচারে ৩০ বছর ধরে জেলে ছিলেন। যদি বিচারও হতো তাহলে হয়তো এতদিনে সাজা খেটে বের হতে পারতেন। কিন্তু তা হয়নি। এটা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। পরিবার অসহায় ছিল, কর্তৃপক্ষও অবহেলা করেছে। এখন তার চিকিৎসা নিশ্চিত করাই আমাদের দায়িত্ব।

কানু মিয়াকে দেখতে যাওয়া হবিগঞ্জ শহরের ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, সংবাদ শুনে দেখতে এসেছি। বিনা বিচারে ৩০ বছর কারাগার ভাবতেই কষ্ট হয়। দ্রুত চিকিৎসা দরকার। প্রতিবেশী ইদ্রিস মিয়া বলেন, শুনেছিলাম চাচা মাকে খুন করে জেলে গেছে। পরে তাকে আমরা ভুলে যাই। এখন ফিরেছেন, কিন্তু আচরণ অস্বাভাবিক। পরিবারও কষ্টে আছে।

হবিগঞ্জ জেলা কারাগারের জেল সুপার মো. মুজিবুর রহমান বলেন, কানু মিয়াকে আলাদাভাবে রাখা হতো। সিলেট ও পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হতো। খাবার না খেতে চাইলে সেবক বন্দিরা কৌশলে খাওয়াতেন। চুল-নখ কাটা, স্নান করানো সব আমরা করতাম। গত ৮ জুলাই লিগ্যাল এইড বিষয়ক সভায় ‘পাগল বন্দিদের’ প্রসঙ্গে কনু মিয়ার নাম উঠে আসে। অফিসার আগ্রহ নিয়ে উদ্যোগ নেন। অবশেষে জামিনের মাধ্যমে মুক্তি পান কানু মিয়া। ২৭ বছরের চাকরিজীবনে এটি আমার সবচেয়ে বড় মানসিক তৃপ্তির জায়গা।
লিগ্যাল এইডের প্যানেলভুক্ত আইনজীবী অ্যাডভোকেট এমএ মজিদ বলেন, মানসিক রোগীদের বিচার স্থগিত থাকে। বিষয়টি সম্পর্কে উচ্চ আদালতও অবগত। তবে আদালতে পরিবারের অনুপস্থিতিতে কানু মিয়া বছরের পর বছর কারাগারেই থেকে যান। শেষ পর্যন্ত লিগ্যাল এইড উদ্যোগ নিয়ে মুক্তি দেয়।

উল্লেখ্য, কানু মিয়ার জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন নেই। স্থানীয়রা পরিচয়পত্র ও সরকারি ভাতা দাবির পাশাপাশি তার জন্য রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও মানবিক সহযোগিতা চান।

আপলোডকারীর তথ্য

news room

জনপ্রিয় সংবাদ

জিয়াকে কটাক্ষ ও সারা‌দে‌শে আইন শৃঙ্খলার অবন‌তির প্রতিবা‌দে ভোলায় যুবদলের বি‌ক্ষোভ মি‌ছিল।

হবিগঞ্জ কারাগারে রায়হীন কানু মিয়ার ৩০ বছর

আপডেট সময় ০৬:০৩:৫১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫
লিটন পাঠান, হবিগঞ্জ প্রতিনিধি : কানু মিয়ার গল্প একসময় মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় নিজের মাকে হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন কানু মিয়া।

এরপর, আদালতের সাজার কোনো রায় ছাড়াই টানা তিন দশক কেটেছে কারাগারে। দুই দশক আগে মামলার কার্যক্রম স্থগিত হলেও মুক্তি মেলেনি তার। অবশেষে জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তার নজরে এলে শুরু হয় আইনি তৎপরতা। আদালতের নির্দেশে দীর্ঘ ৩০ বছরের বন্দিজীবনের অবসান ঘটে কানু মিয়ার। মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) দুপুরে হবিগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। মুক্তি পাওয়া কানু মিয়ার বয়স এখন ৫০ বছর।

তার বাড়ি হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার সিংহগ্রামে। বাবার নাম চিনি মিয়া (মৃত)। সরেজমিনে কানু মিয়ার বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, মাত্র চার শতক জমির ওপর ছোট চারটি টিনের ঘরে তার তিন ভাই পরিবার নিয়ে গাদাগাদি করে থাকেন। বাড়ির উঠানে বসে থাকা কানু মিয়ার পাশে হাতপাখা করছেন ভাতিজি জোসনা বেগম।

আপাশের লোকজনও ফিরে পাওয়া স্বজনকে ঘিরে কথা বলছেন। শদুই মায়ের ঘরে সাত ভাইবোনের মধ্যে কানু মিয়া ষষ্ঠজন। দরিদ্রতা কারণে পরিবার তার চিকিৎসাও করাতে পারেনি। এখনও মাঝেমধ্যে অসংলগ্ন কথা বলেন কানু।

পরিবার বলছে, চিকিৎসা প্রয়োজন, কিন্তু সামর্থ্য নেই। বড় ভাই নসু মিয়া জানান, কানু ঢাকায় কাজ করত, তখন বয়স ২৫। জ্বরে অসুস্থ হয়ে পড়েন এক সময়। পরে তার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এরপর কাজ ছেড়ে বাড়ি ফেরেন কানু। ১৯৯৫ সালের ২৫ মে হঠাৎ ঘরে ঢুকে মায়ের গলায় কোদাল দিয়ে কোপ দেন তিনি। হাসপাতালে নেওয়ার পথে মা মারা যান। পরে পুলিশ তাকে আটক করে। তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে তখন কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি। পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। প্রথমে সিলেট, পরে হবিগঞ্জ কারাগারে রাখা হয় কানু মিয়াকে। কারাগারে যাওয়ার দশ বছর পর এক মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দির মাধ্যমে তারা জানতে পারেন কানু জীবিত। বিশ বছর পর তারা ভাইকে একবার দেখে এসেছিলেন তিনি আরও বলেন।

কানুরে এখন আমরা সবাই মিল্লা খেয়াল রাখরাম আমরার ভাই বইল্লা খতা, ফালাইতাম তো ফারতাম না। তবে চিখিৎসা সাহায্য দরখার আসে। রাতে আমার সাইডে ঘুমায়, কিন্তু আমার তো ডর লাগে। কানুকে এখন আমরা সবাই মিলে সেবা করছি। ভাই বলে কথা, ফেলে দিতে পারি না। তবে চিকিৎসায় সহযোগিতা দরকার। রাতে আমার পাশে ঘুমায়, কিন্তু ঘুমাতে ভয় লাগে। ৩০ বছরের বন্দী জীবন সম্পর্কে কানু মিয়ার কাছ থেকে জানার চেষ্টা করে বাংলানিউজ। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কথা বলানো যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে নিজেই কথা বলে ওঠেন।

তিনি বলেন, ‘ভালা লাগছে, আমেরিকাত থাকিয়া আইছি তাই ভালা লাগতাছে।’ এরপর কিছু অসংলগ্ন কথা বলেন। মায়ের মুখ এখনও মনে আছে বলেও জানান। কানুর ভাতিজি জোসনা তার চিকিৎসার জন্য সবার সহযোগিতা চেয়েছেন।

স্থানীয় মানবাধিকারকর্মী সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা সহসভাপতি বাহার উদ্দিন বলেন, জানতামই না গ্রামে এমন কেউ বিনা বিচারে ৩০ বছর ধরে জেলে ছিলেন। যদি বিচারও হতো তাহলে হয়তো এতদিনে সাজা খেটে বের হতে পারতেন। কিন্তু তা হয়নি। এটা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। পরিবার অসহায় ছিল, কর্তৃপক্ষও অবহেলা করেছে। এখন তার চিকিৎসা নিশ্চিত করাই আমাদের দায়িত্ব।

কানু মিয়াকে দেখতে যাওয়া হবিগঞ্জ শহরের ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, সংবাদ শুনে দেখতে এসেছি। বিনা বিচারে ৩০ বছর কারাগার ভাবতেই কষ্ট হয়। দ্রুত চিকিৎসা দরকার। প্রতিবেশী ইদ্রিস মিয়া বলেন, শুনেছিলাম চাচা মাকে খুন করে জেলে গেছে। পরে তাকে আমরা ভুলে যাই। এখন ফিরেছেন, কিন্তু আচরণ অস্বাভাবিক। পরিবারও কষ্টে আছে।

হবিগঞ্জ জেলা কারাগারের জেল সুপার মো. মুজিবুর রহমান বলেন, কানু মিয়াকে আলাদাভাবে রাখা হতো। সিলেট ও পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হতো। খাবার না খেতে চাইলে সেবক বন্দিরা কৌশলে খাওয়াতেন। চুল-নখ কাটা, স্নান করানো সব আমরা করতাম। গত ৮ জুলাই লিগ্যাল এইড বিষয়ক সভায় ‘পাগল বন্দিদের’ প্রসঙ্গে কনু মিয়ার নাম উঠে আসে। অফিসার আগ্রহ নিয়ে উদ্যোগ নেন। অবশেষে জামিনের মাধ্যমে মুক্তি পান কানু মিয়া। ২৭ বছরের চাকরিজীবনে এটি আমার সবচেয়ে বড় মানসিক তৃপ্তির জায়গা।
লিগ্যাল এইডের প্যানেলভুক্ত আইনজীবী অ্যাডভোকেট এমএ মজিদ বলেন, মানসিক রোগীদের বিচার স্থগিত থাকে। বিষয়টি সম্পর্কে উচ্চ আদালতও অবগত। তবে আদালতে পরিবারের অনুপস্থিতিতে কানু মিয়া বছরের পর বছর কারাগারেই থেকে যান। শেষ পর্যন্ত লিগ্যাল এইড উদ্যোগ নিয়ে মুক্তি দেয়।

উল্লেখ্য, কানু মিয়ার জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন নেই। স্থানীয়রা পরিচয়পত্র ও সরকারি ভাতা দাবির পাশাপাশি তার জন্য রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও মানবিক সহযোগিতা চান।