ঢাকা , রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫, ৪ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
মুলাদীতে পৌরসভা বিএনপির সাংগঠনিক কার্যাক্রম গতিশীল করার লক্ষে প্রতিনিধি সভা অনুষ্ঠিত বিদ্যুৎ অফিস স্থানান্তরের সিদ্ধান্তে ফুঁসে উঠেছেন জগন্নাথপুরবাসী। তারেক রহমানকে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য ও স্লোগানের প্রতিবাদে মহানগরীতে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ আওয়ামিলীগ নেতা লোকমান বিএনপি নাম ভাঙ্গিয়ে পায়দা লোটার চেষ্টা  রাজশাহী নগরীতে পুকুরে ডুবে স্কুলছাত্রের মৃত্যু উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব হিসেবে মজিবর রহমান মজু’কে চাইছে ভালুকাবাসী  রাজশাহীতে বই পড়ে পুরস্কার পেল ছাত্র -ছাত্রীরা জুলাই শহীদদের স্মরণে মুন্সিগঞ্জে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত  বাকেরগঞ্জে গাছ থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু বরিশালে চাঁদাবাজি সহ একাধিক মামলা ! তদন্তে পুলিশ গৃহ ছারছেন সাংবাদিক 

কোরবানির ঈদে নেই আগের সেই ব্যস্ততা আধুনিকতার ভিড়ে কোণঠাসা গৌরীপুরের কামারশিল্পীরা

কোরবানির ঈদে নেই আগের সেই ব্যস্ততা আধুনিকতার ভিড়ে কোণঠাসা গৌরীপুরের কামারশিল্পীরা

ওবায়দুর রহমান, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি : কুরবানির ঈদে আগের মতো ব্যস্ততা নেই ময়মনসিংহের গৌরীপুরের কামারশিল্পীদের। আগে কুরবানির ঈদে ছিল কামারপাড়ায় কর্মচাঞ্চল্য, লৌহ ও ধাতব পদার্থের টং টং শব্দে প্রতিধ্বনিত হতো ছুরি-বঁটি শান দেওয়ার সুর। গ্রামের হাট-বাজারের কামারদের হাতে তৈরি ধারালো কোরবানির কাজে ব্যবহৃত নতুন লোহার ছুরি, চাকু, চাপাতি, দা, বঁটিসহ নানা সরঞ্জাম হচ্ছে অন্যতম অনুষঙ্গ।

সেইসব সরঞ্জমাদি নতুন তৈরি ও কোরবানির পশুর মাংস কাটার পুরোনো সরঞ্জমাদি শান দিতে কামারশিল্পীদের দেখা গেলেও কিন্তু সেই চিরচেনা দৃশ্য যেন এখন কেবলই স্মৃতিচারণ। আধুনিক যন্ত্রপাতি, চাইনিজ পণ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কৃতির কারণে ঈদ মৌসুমেও আর আগের মতো কাজ পাচ্ছেন না কামাররা। গৌরীপুর পৌর শহরের ৭টি কামারের দোকানসহ উপজেলায় অর্ধশতাধিক কামারের দোকান রয়েছে।

গৌরীপুর পৌর শহরের স্থানীয় কামার মাখন বাড়ৈ দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে কামারের কাজ করছেন। তিনি বললেন, “আগে ঈদের এক মাস আগে থেকেই কাজের চাপ শুরু হতো। বাজার থেকে মানুষ ছুরি, বঁটি, চাকু বানাতে আসত, পুরনোগুলো শান দিত। এক একদিনে ৫০-৬০টা শান দিতে হতো। এখন ৫-১০টা কাজ নিয়েই বসে থাকি। এই পেশায় টিকে থাকাই কঠিন হয়ে গেছে।”


তার মতোই হতাশ কামার জমশেদ আলী। তিনি বলেন, “মানুষ এখন দোকান থেকে রেডিমেড ছুরি-বঁটি কিনে নেয়। চায়না বঁটি, চাপাতি দেখতে সুন্দর, দামেও সস্তা। কিন্তু আমাদের তৈরি যন্ত্রপাতি অনেক বেশি টেকসই। তারপরও কেউ গুরুত্ব দেয় না।”


কামার দোকানী রাজকুমার বিন বলেন, “ঈদের দুই সপ্তাহ আগে থেকেই প্রতিদিন গড়ে ১৫-২০টি নতুন সরঞ্জমাদি বানাতাম আর শতাধিক পুরোনো সরঞ্জমাদি শান দিতে পারতাম। বর্তমানে সারাদিনে ৭-৮টি নতুন ও ৫০-৬০টা পুরোনো সরঞ্জমাদি শান দিতে পারি।”

আরেক কামারশিল্পী টনি বাড়ৈ জানান, “বর্তমানে জনপ্রতিনিধি না থাকায় ও বিগত সরকারের নেতাকর্মীদের অনেকেই এলাকায় না থাকায় কোরবানির সংখ্যা কমে গেছে। যার ফলস্বরূপ এবার আমাদের ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। আমাদেরকে সরকারি সহায়তা দিলে আমরা এই শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবো।”

কামার শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা জানান, লোহা, কয়লা ও অন্যান্য কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব সরঞ্জামাদি তৈরিতে বেড়েছে খরচ। বর্তমানে পশুর চামড়া ছাড়ানো ছুরি ১৫০ থেকে ৩০০, দা ২৫০ থেকে ৪০০, বঁটি ৩০০ থেকে ৫০০, পশু জবাইয়ের ছুরি ৪০০ থেকে ১০০০ টাকায়, চাপাতি ৫০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফলে এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত কারিগর ও শ্রমিকরা পরেছেন চরম বিপাকে। সবমিলিয়ে নিদারুণ অর্থকষ্টে কাটাতে হচ্ছে তাদের দিনগুলো। অনেকের আবার অন্য পেশা জানা না থাকায় বাধ্য হয়েই আঁকড়ে ধরে আছেন বাপ-দাদার কাছ থেকে শেখা এই পেশায়।

শুধু শহরেই নয়, গ্রামীণ এলাকাগুলোতেও দেখা যাচ্ছে একই চিত্র। একসময় ঈদের আগে কামারদের সামনে লাইন দিয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকত। আজ সেই ভিড় উধাও। বাজারে গেলেই চোখে পড়ে রঙিন হ্যান্ডেল, ঝকঝকে ধারালো রেডিমেড ছুরি ও চাপাতি, যেগুলোর বেশিরভাগই চীন থেকে আমদানি করা। এসব পণ্য দ্রুত ব্যবহারযোগ্য হলেও বেশি দিন টেকে না বলে মত দিয়েছেন অনেক ব্যবহারকারী।

তবে কিছু মানুষ এখনো কামারদের পাশে থাকার চেষ্টা করছেন। স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ খোরশেদ আলম বলেন, “আমি প্রতি বছর কামারদের কাছ থেকেই বঁটি শান করিয়ে নিই। কারণ ওদের তৈরি জিনিস যেমন টেকসই, তেমনি শান দিলে অনেক ভালো কাটে। কিন্তু নতুন প্রজন্ম তাড়াহুড়ায় দোকান থেকেই কিনে নেয়।”

গৌরীপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম মিন্টু বলেন, কামার শিল্প শুধু একটি পেশা নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যুগের পরিবর্তনে প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি হলেও ঐতিহ্যকে ধরে রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। অনেক কামার এখন এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। যারা এখনো টিকে আছেন, তাদের অনেকেই দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবনযাপন করছেন।

গৌরীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মোহাম্মদ জানান, ঈদ শুধু আনন্দ ও উৎসবের সময় নয়, এটি শ্রমজীবী মানুষদের মুখে হাসি ফোটানোরও সময়। কামারদের মতো পরিশ্রমী হস্তশিল্পীদের অবহেলার কারণেই আজ একটি প্রাচীন ও প্রয়োজনীয় শিল্প বিলুপ্তির পথে। এখনই সময় এদের পাশে দাঁড়ানোরতাদের কাজের মূল্যায়ন করা এবং ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়ার।

আপলোডকারীর তথ্য

news room

জনপ্রিয় সংবাদ

মুলাদীতে পৌরসভা বিএনপির সাংগঠনিক কার্যাক্রম গতিশীল করার লক্ষে প্রতিনিধি সভা অনুষ্ঠিত

কোরবানির ঈদে নেই আগের সেই ব্যস্ততা আধুনিকতার ভিড়ে কোণঠাসা গৌরীপুরের কামারশিল্পীরা

আপডেট সময় ০১:১৯:৫৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ জুন ২০২৫

ওবায়দুর রহমান, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি : কুরবানির ঈদে আগের মতো ব্যস্ততা নেই ময়মনসিংহের গৌরীপুরের কামারশিল্পীদের। আগে কুরবানির ঈদে ছিল কামারপাড়ায় কর্মচাঞ্চল্য, লৌহ ও ধাতব পদার্থের টং টং শব্দে প্রতিধ্বনিত হতো ছুরি-বঁটি শান দেওয়ার সুর। গ্রামের হাট-বাজারের কামারদের হাতে তৈরি ধারালো কোরবানির কাজে ব্যবহৃত নতুন লোহার ছুরি, চাকু, চাপাতি, দা, বঁটিসহ নানা সরঞ্জাম হচ্ছে অন্যতম অনুষঙ্গ।

সেইসব সরঞ্জমাদি নতুন তৈরি ও কোরবানির পশুর মাংস কাটার পুরোনো সরঞ্জমাদি শান দিতে কামারশিল্পীদের দেখা গেলেও কিন্তু সেই চিরচেনা দৃশ্য যেন এখন কেবলই স্মৃতিচারণ। আধুনিক যন্ত্রপাতি, চাইনিজ পণ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কৃতির কারণে ঈদ মৌসুমেও আর আগের মতো কাজ পাচ্ছেন না কামাররা। গৌরীপুর পৌর শহরের ৭টি কামারের দোকানসহ উপজেলায় অর্ধশতাধিক কামারের দোকান রয়েছে।

গৌরীপুর পৌর শহরের স্থানীয় কামার মাখন বাড়ৈ দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে কামারের কাজ করছেন। তিনি বললেন, “আগে ঈদের এক মাস আগে থেকেই কাজের চাপ শুরু হতো। বাজার থেকে মানুষ ছুরি, বঁটি, চাকু বানাতে আসত, পুরনোগুলো শান দিত। এক একদিনে ৫০-৬০টা শান দিতে হতো। এখন ৫-১০টা কাজ নিয়েই বসে থাকি। এই পেশায় টিকে থাকাই কঠিন হয়ে গেছে।”


তার মতোই হতাশ কামার জমশেদ আলী। তিনি বলেন, “মানুষ এখন দোকান থেকে রেডিমেড ছুরি-বঁটি কিনে নেয়। চায়না বঁটি, চাপাতি দেখতে সুন্দর, দামেও সস্তা। কিন্তু আমাদের তৈরি যন্ত্রপাতি অনেক বেশি টেকসই। তারপরও কেউ গুরুত্ব দেয় না।”


কামার দোকানী রাজকুমার বিন বলেন, “ঈদের দুই সপ্তাহ আগে থেকেই প্রতিদিন গড়ে ১৫-২০টি নতুন সরঞ্জমাদি বানাতাম আর শতাধিক পুরোনো সরঞ্জমাদি শান দিতে পারতাম। বর্তমানে সারাদিনে ৭-৮টি নতুন ও ৫০-৬০টা পুরোনো সরঞ্জমাদি শান দিতে পারি।”

আরেক কামারশিল্পী টনি বাড়ৈ জানান, “বর্তমানে জনপ্রতিনিধি না থাকায় ও বিগত সরকারের নেতাকর্মীদের অনেকেই এলাকায় না থাকায় কোরবানির সংখ্যা কমে গেছে। যার ফলস্বরূপ এবার আমাদের ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। আমাদেরকে সরকারি সহায়তা দিলে আমরা এই শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবো।”

কামার শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা জানান, লোহা, কয়লা ও অন্যান্য কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব সরঞ্জামাদি তৈরিতে বেড়েছে খরচ। বর্তমানে পশুর চামড়া ছাড়ানো ছুরি ১৫০ থেকে ৩০০, দা ২৫০ থেকে ৪০০, বঁটি ৩০০ থেকে ৫০০, পশু জবাইয়ের ছুরি ৪০০ থেকে ১০০০ টাকায়, চাপাতি ৫০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফলে এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত কারিগর ও শ্রমিকরা পরেছেন চরম বিপাকে। সবমিলিয়ে নিদারুণ অর্থকষ্টে কাটাতে হচ্ছে তাদের দিনগুলো। অনেকের আবার অন্য পেশা জানা না থাকায় বাধ্য হয়েই আঁকড়ে ধরে আছেন বাপ-দাদার কাছ থেকে শেখা এই পেশায়।

শুধু শহরেই নয়, গ্রামীণ এলাকাগুলোতেও দেখা যাচ্ছে একই চিত্র। একসময় ঈদের আগে কামারদের সামনে লাইন দিয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকত। আজ সেই ভিড় উধাও। বাজারে গেলেই চোখে পড়ে রঙিন হ্যান্ডেল, ঝকঝকে ধারালো রেডিমেড ছুরি ও চাপাতি, যেগুলোর বেশিরভাগই চীন থেকে আমদানি করা। এসব পণ্য দ্রুত ব্যবহারযোগ্য হলেও বেশি দিন টেকে না বলে মত দিয়েছেন অনেক ব্যবহারকারী।

তবে কিছু মানুষ এখনো কামারদের পাশে থাকার চেষ্টা করছেন। স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ খোরশেদ আলম বলেন, “আমি প্রতি বছর কামারদের কাছ থেকেই বঁটি শান করিয়ে নিই। কারণ ওদের তৈরি জিনিস যেমন টেকসই, তেমনি শান দিলে অনেক ভালো কাটে। কিন্তু নতুন প্রজন্ম তাড়াহুড়ায় দোকান থেকেই কিনে নেয়।”

গৌরীপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম মিন্টু বলেন, কামার শিল্প শুধু একটি পেশা নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যুগের পরিবর্তনে প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি হলেও ঐতিহ্যকে ধরে রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। অনেক কামার এখন এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। যারা এখনো টিকে আছেন, তাদের অনেকেই দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবনযাপন করছেন।

গৌরীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মোহাম্মদ জানান, ঈদ শুধু আনন্দ ও উৎসবের সময় নয়, এটি শ্রমজীবী মানুষদের মুখে হাসি ফোটানোরও সময়। কামারদের মতো পরিশ্রমী হস্তশিল্পীদের অবহেলার কারণেই আজ একটি প্রাচীন ও প্রয়োজনীয় শিল্প বিলুপ্তির পথে। এখনই সময় এদের পাশে দাঁড়ানোরতাদের কাজের মূল্যায়ন করা এবং ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়ার।